আজ, আমরা ওয়েব হোস্টিং-এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানব যা ওয়েবসাইটগুলিকে ইন্টারনেটে সক্রিয় করে তোলে। আপনি যদি একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান বা আপনি কীভাবে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করবেন তা জানতে চান, তাহলে আপনার ওয়েব হোস্টিং সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরী।
ওয়েব হোস্টিং কি
মৌলিকভাবে, ওয়েব হোস্টিং হল এমন একটি সার্ভিস যা মানুষ এবং সংস্থাগুলিকে তাদের ওয়েবসাইটগুলির জন্য ফাইল, তথ্য এবং উপাদানগুলিকে সার্ভার হিসাবে পরিচিত একটি শক্তিশালী কম্পিউটারে সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা প্রদান করে৷ এই সার্ভার কম্পিউটারটি ২৪ ঘন্টা ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকে, যার কারণে ইউজাররা দিন রাত সবসময় আপনার ওয়েবসাইট দেখতে সক্ষম হয়।
ওয়েব হোস্টিং এর ধরন
খরচ করা অর্থের উপর ভিত্তি করে সকল হোস্টিংকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়।
- ফ্রি হোস্টিং
- পেইড হোস্টিং
খুব সহজেই এদের প্রধান পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে। ফ্রি হোস্টিং মুলত বিনামূল্যে হয়। অর্থাৎ ফ্রি হোস্টিং কিনতে আপনাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। আর পেইড হোস্টিং আপনাকে কিনে ব্যবহার করতে হবে। এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে ফ্রি হোস্টিং থাকতে আপনি টাকা দিয়ে কেন পেইড হোস্টিং কিনবেন? এর উত্তর হল, ফ্রি হোস্টিং এ আপনি স্টোরেজ ও ব্যান্ডউইথ অনেক কম পাবেন। ফলে আপনার ওয়েবসাইট লোড হতে অনেক সময় লেগে যাবে। তাছাড়া ফ্রি হোস্টিং এ সিকিউরিটি থাকে না কোনো। আপনার ওয়েবসাইটের যাবতীয় তথ্য যেকোনো সময় চুরি হয়ে যেতে পারে। এসব কারনে সবাই পেইড হোস্টিং কিনে নেয়।
ফ্রি হোস্টিং এর ধরন নিয়ে আলোচনার খুব বেশি সুযোগ নেই। তবে পেইড হোস্টিং হতে পারে অসংখ্য ধরনের। সে সকল ধরনের প্রকৃতি বিবেচনায় প্রধান কয়েকটি ধরন সম্পর্কেই আলোচনা করা হলো এখানে।
শেয়ার্ড হোস্টিং
শেয়ারড হোস্টিং হলো এমন এক ধরনের হোস্টিং যেখানে একই সার্ভারে কয়েকটি থেকে কয়েকশ ওয়েবসাইটকে হোস্ট করা হয়ে থাকে। তবে এক সার্ভারে হলেও একে অপরের ডাটা দেখার কোনো সুযোগথাকে না। শেয়ারড হোস্টিং এর মান কেমন হবে তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকলেও ভাল হোস্টিং প্রোভাইডার হলে অনেকটাই চিন্তামুক্ত থাকা যায়। সাধারণত ছোট থেকে মাঝারি ওয়েবসাইট
গুলো এ ধরনের হোস্টিং ব্যবহার করে।
সুবিধাদি:
- সেট আপ করা সহজ
- সস্তা মাসিক বা বার্ষিক ফি
- খুব বেশি জটিল কনফিগারেশনের প্রয়োজন হয় না, আগে থেকেই কনফিগার করা থাকে
- একক অ্যাকাউন্টে একাধিক সাইট হোস্ট করার ক্ষমতা
অসুবিধা:
- সার্ভার কনফিগারেশন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়
- হেভি-ট্রাফিক সম্পন্ন সাইটের জন্য এমন হোস্টিং ভাল নয়
ভিপিএস হোস্টিং (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার)
ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার মূলত শেয়ারড হোস্টিং এরই আরেকটি রূপ যেখানে এক সার্ভারে একাধিক ওয়েবসাইট হোস্ট করা হলেও প্রত্যেক ওয়েবসাইট নিজস্ব রিসোর্স পায়। অর্থাৎ এখানে প্রতিটি ওয়েবসাইটের জন্য একটি করে ভার্চুয়াল পার্টিশন তৈরি করা হয়। ফলে সার্ভারের কিছু নির্দিষ্ট অংশ শুধু ওই ওয়েবসাইটের জন্যই কাজ করে। এতে করে শেয়ারড হোস্টিং এর এক সাইটের ট্রাফিকের কারণে অন্য সাইটের প্রভাবিত হওয়ার যে সমস্যা সেটি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সুবিধাদি:
- কাস্টমাইজেশন এর সুবিধা আছে
- ডেডিকেটেড সার্ভার স্পেস
- রুট অ্যাক্সেস অন্তর্ভুক্ত
অসুবিধা:
- প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রয়োজন
- শেয়ার্ড হোস্টিং এর চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল
ডেডিকেটেড হোস্টিং
এই হোস্টিং প্রোভাইডার আপনাকে সম্পূর্ণরূপে ফিজিক্যাল সার্ভারে অ্যাক্সেস সুবিধা প্রদান করে। ওয়েবসাইটে ট্রাফিক বা ভিজিটর খুব বেশি হলে শেয়ারড হোস্টিং সেই চাপ কন্ট্রোল করতে পারে না। ফলে সাইট ডাউন হয়ে যায়। তাই ডেডিকেটেড সার্ভার দরকার হয়। আপনার ওয়েবসাইট যদি খুব বড় হয় এবং খুব শক্ত নিরাপত্তা দরকার হয়, তখনই এই হোস্টিং আপনার জন্য বেস্ট হবে।
সুবিধাদি:
- রুট অ্যাক্সেস অন্তর্ভুক্ত
- অনেক বেশি ট্রাফিক বা ভিসিটর হ্যান্ডেল করতে পারে
- এই রকমের হোস্টিং অনেক নিরাপদ
- কর্মক্ষমতা অন্যদের থেকে অনেক গুনে বেশি
অসুবিধা:
- ব্যয়বহুল
- ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারীদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকতে হবে
রিসেলার হোস্টিং
মূলত নিজের ডিস্ক স্পেস অন্যের সাথে শেয়ার করা। আপনি আপনার কেনা সার্ভারে অন্য কাউকে ফাইল রাখার অনুমতি দিয়ে তার বিনিময়ে টাকা নিবেন। এটাই রিসেলার হোস্টিং। এটি হল ওয়েব হোস্টিং এর একটি ধরন যেখানে অ্যাকাউন্টের মালিক তার বরাদ্দ করা হার্ড ড্রাইভ স্পেস এবং ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষের হয়ে একটি ওয়েবসাইট হোস্ট করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে ‘রিসেলার’ আসল হোস্টিং অ্যাকাউন্টের মালিক।
বিভিন্ন ব্যক্তি বা ছোট প্রতিষ্ঠান যারা তাদের ক্লায়েন্ট দের ওয়েবসাইট বানিয়ে দেন তারা রিসেলার হোস্টিং কিনে তাদের ক্লায়েন্ট এর কাছে এই হোস্টিং গুলো সেল করে থাকেন।
সুবিধাদি:
- সেট আপ করা সহজ
- সস্তা মাসিক বা বার্ষিক ফি
- অন্তর্নির্মিত ডাটাবেস সফ্টওয়্যার এবং সাইট নির্মাতা
- একক অ্যাকাউন্টে একাধিক সাইট হোস্ট করার ক্ষমতা
অসুবিধা:
- সার্ভার কনফিগারেশন নিয়ন্ত্রণ সীমিত
ক্লাউড হোস্টিং
ক্লাউড হোস্টিং এ অনেক গুলি ওয়েব সার্ভার একসাথে রাখা হয়। তাই আপনি আপনার প্রয়োজন অনুসারে সার্ভারের কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় কাস্টমাইজ করে নিতে পারবেন। যেমন cpu, RAM বা storage বাড়িয়ে বা কমিয়ে নিতে পারবেন। এতে, যখনি আপনার ওয়েবসাইটে ট্রাফিক বা ভিসিটর বাড়বে আপনি অনেক সহজে সেই হিসেবে নিজের ওয়েব সার্ভারের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে নিতে পারবেন। আবার যখন ভিজিটর কম থাকবে তখন কমিয়ে নিতে পারবেন। আপনি চাইরে লোড ব্যালেঞ্চিং করে নিতে পারবেন।
সুবিধাদি:
- সার্ভার ডাউন হওয়ার ভয় থাকে খুবই কম
- কর্মক্ষমতা অনেক বেশি উন্নত, নিজের প্রয়োজন মতো বাড়িয়ে কমিয়ে নেওয়া যায়
- নিরাপত্তা বৃদ্ধি
- স্বয়ংক্রিয় ডেটা ব্যাকআপ
অসুবিধা:
- ব্যয়বহুল
- রুট অ্যাক্সেস প্রদান করা হয় না
ওয়েব হোস্তিং কিভাবে কাজ করে
আপনার ওয়েবসাইট দেখার জন্য একজন ব্যবহারকারীকে শুধুমাত্র তাদের ওয়েব ব্রাউজারে আপনার ডোমেইন নাম (URL) লিখতে হবে। আপনার ওয়েবসাইট হোস্ট করা সার্ভার, ব্রাউজার থেকে একটি অনুরোধ গ্রহণ করে। ব্যবহারকারীর ব্রাউজার তখন সার্ভার থেকে HTML, ছবি, ভিডিও এবং অন্যান্য উপাদান সহ প্রাসঙ্গিক ফাইল এবং ডেটা গ্রহণ করে। মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ডে এই দ্রুত, ত্রুটিহীন প্রক্রিয়াটির জন্য ব্যবহারকারীরা আপনার ওয়েবসাইট অ্যাক্সেস করতে পারে।
হোস্টিং কেনার পূর্বে যে কথা গুলো ভাববেন
ডিস্ক স্পেস / স্টোরেজ: একটি স্মার্টফোনে ছবি, ভিডিও এবং গান ইত্যাদি রাখার জন্য যেমন স্টোরেজের প্রয়োজন হয় । ঠিক তেমনই, একটি ওয়েবসাইটের ফাইলগুলি সংরক্ষণ করার জন্যও স্টোরেজের প্রয়োজন হয় । তাই ওয়েব হোস্টিং কেনার আগে, আপনার হোস্টিং এর ডিস্ক স্পেস বা স্টোরেজের দিকে খেয়াল রাখা উচিত । আপনি কি ধরনের ওয়েবসাইট তৈরি করছেন, তার উপর ভিত্তি করে আপনার কেমন স্টোরেজ প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণ করুন এবং সেই অনুযায়ী স্টোরেজ সহ হোস্টিং কিনুন।
ধরুন আপনি যদি একটি সাধারণ ব্লগ ওয়েবসাইটের জন্য হোস্টিং কিনতে চান, তাহলে আনলিমিটেড স্টোরেজ কেনার প্রয়োজন নেই । কারণ একটি ব্লগে তেমন কোন ডেটা থাকে না । কয়েকটি এইচটিএমএল পেজ এবং কিছু ছবি থাকে, যার ফলে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না । এজন্য একটি ব্লগের জন্য ২ থেক ৫ GB স্টোরেজই যথেষ্ট । আপনি যত বেশি স্টোরেজ নিবেন, আপনাকে তত বেশি টাকা খরচ করতে হবে । তবে আমরা সাজেস্ট করব আপনার প্রয়োজনের চেয়ে সামান্য একটু বেশি স্টোরেজ সহ হোস্টিং প্যাকেজ কিনুন ।
ব্যান্ডউইথ: প্রতিবার ভিজিটর যতগুলো পেজ আপনার ওয়েবসাইট ভিজিট করে, ততগুলো পেজ, ছবি, গান, ভিডিও অর্থাৎ ওইসব পেজে যা কিছু আছে সবগুলোই পাঠকের কম্পিউটারে ডাউনলোড হয়। প্রাথমিক অবস্থায় একটা সাইটের ১ জিবি ব্যান্ডউইথ ও যথেষ্ট। পারসোনাল সাইটের জন্য এর চেয়ে বেশি লাগার কথা না। আর আপনার সাইটে যদি প্রচুর ইমেজ, ভিডিও ইত্যাদি থাকে তাহলে প্রচুর ব্যান্ডউইথ লাগতে পারে। ১০-১০০ জিবি অথবা তারচেয়ে ও বেশি।
কন্ট্রোল প্যানেল: আপনার ওয়েব সাইট ম্যানেজ করার জন্য কন্ট্রোল প্যানেল প্রয়োজন। কন্ট্রোল প্যানেলের সাহায্যে আপনি আপনার ওয়েব সাইট সহজেই ম্যানেজ করতে পারেন। ওয়েব হোস্টিং এ সব চেয়ে সহজ এবং অধিক ফিচার সমৃদ্ধ কন্ট্রোল প্যানেল হচ্ছে সিপ্যানেল। তাই সবসময় সিপ্যানেল হোস্টিং নেয়ার কথা চিন্তা করুন।
হোস্টিং সার্ভার লোকেশন: ওয়েব সাইট এর জন্য হোস্টিং সার্ভার লোকেশন অনেক গুরুন্তপূর্ণ। আপনার ওয়েব সাইটটি যদি বাংলাদেশী ট্রাফিক ওরিয়েন্টেড হয় তাহলে আপনার জন্য BDIX হোস্টিং হতে পারে বেস্ট অপশন। আর আপনার ওয়েব সাইটটি যদি গ্লোবাল ট্রাফিক ওরিয়েন্টেড হয় তবে USA সার্ভার ব্যবহার করতে পারেন।
২৪/৭ সাপোর্ট: এটা জেনে নেওয়া খুবই গুরুক্তপূর্ন যে আপনি সবসময় সাপোর্ট পাবেন কিনা। সার্ভার সংক্রান্ত যেকোন সমস্যা যেকোন সময় হতে পারে। সেটা হোক দিন বা রাত। প্রায় সব কোম্পানি ২৪/৭ সাপোর্ট এর কথা বলে। অনেকে অভিযোগ করেন কোম্পানি সাপোর্ট দেয়না, কল ধরেনা, মেইল রিপ্লাই দেইনা ইত্যাদি। আপনার ব্যবসা বা যে কাজেই ওয়েবসাইট করেন না কেন তা অবশ্যই গুরুক্তপূর্ন। আর সাইট সবসময় চালু রাখতে কোন সমস্যা হলে, সেটা দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। তাই সাপোর্ট ঠিকমত দিবে কিনা অবশ্যই ভালভাবে জেনে নিবেন।
মানিব্যাক গ্যারান্টি: মানিব্যাক গ্যারান্টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। অনেক কোম্পানিই ৩০ দিনের মানিব্যাক গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। কেনার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন কোম্পানি মানিব্যাক গ্যারান্টি দিচ্ছে কিনা।
আপগ্রেড করার সুবিধা: ধরুন আপনি শুরুর দিকে একটি 2GB Hosting Plan কিনলেন। কিন্তুু একটা সময় আপনার ওয়েবসাইটে ভিজিটর বেড়ে গেলো। সেই সময়ে আপনার হোস্টিং প্ল্যানকে Upgrade করতে হতে পারে। এখন আপনি যে কোম্পানি থেকে হোস্টিং কিনবেন, তারা আপনাকে এই আপগ্রেড করার সুযোগ সুবিধা দিবে কিনা। সেটি সম্পর্কে অবশ্যই জেনে নিবেন।
উপসংহার
ওয়েব হোস্টিং হল আপনার অনলাইন উপস্থিতির ভিত্তি কারণ এটি আপনার ওয়েবসাইটের উন্নতির জন্য একটি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য পরিবেশ প্রদান করে। আপনি যদি ওয়েব হোস্টিং এর সূক্ষ্মতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তবে আপনি আপনার ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তার জন্য আদর্শ হোস্টিং প্রদানকারী বেছে নিতে সক্ষম হবেন। আপনি একটি ব্যক্তিগত ব্লগ, একটি অনলাইন স্টোর, বা একটি পেশাদার পোর্টফোলিও শুরু করছেন কিনা, আপনার ডিজিটাল সাফল্যকে রূপ দেওয়ার জন্য ওয়েব হোস্টিং অপরিহার্য।
সুতরাং, এই নতুন তথ্যের সাথে সজ্জিত, ওয়েব হোস্টিং শিল্পে প্রবেশ করুন এবং অনলাইনে নিজের জন্য একটি নাম তৈরি করুন! হ্যাপি হোস্টিং এবং ইন্টারনেট বিশ্ব আপনার ওয়েবসাইটে সদয় হতে পারে